নিজস্ব প্রতিবেদক : হবিগঞ্জের মাধবপুরে ভাবির কাছে প্রতারণা আর উপহাসের শিকার হয়েই ৩ জনকে হত্যা করেছে ঘাতক তাহের মিয়া। বুধবার হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শামসাদ বেগমের আদালতে সে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা প্রদান করে বলে নিশ্চিত করেছেন মাধবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোক্তাদির হোসেন ও কোর্ট ইন্সপেক্টর কাজী কামাল হোসেন।
তিনি জানান, ঘাতক তাহেরকে বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টায় বিজ্ঞ হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শামসাদ বেগমের আদালতে হাজির করা হয়। বিকাল ৫টা পর্যন্ত দেয়া জবানবন্দিতে ঘাতক তাহের হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি প্রদান করে।
তাহের তার বক্তব্যে জানায়, ভাবির দ্বারা দফায় দফায় প্রতারিত আর উপহাসের শিকার হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তাহের উদ্দিন। এ কারণেই ভাবিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় সে । এ সময় অন্যরা ছুটে আসায় তাদেরও আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে তিনজন। হত্যাকাণ্ড তাহের উদ্দিন একাই ঘটিয়েছে।
ঘাতক তাহের আরো জানায়, ১১ বছর কুয়েত এবং গ্রিসে ছিল। সেখান থেকে তিনি তার ভাবি জাহানারা বেগমের কাছে উপার্জিত টাকা পাঠাত। কিন্তু দেশে ফেরার পর তিনি তার টাকা ফেরত পায়নি। এছাড়াও ভাবির দ্বারা তিনি বিভিন্নভাবে প্রতারিত হয়ে ২ বছর বয়সী সন্তানসহ আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করত।
সম্প্রতি জমিজমা বিক্রি করে তিনি বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ফ্লাইট জটিলতায় তার যাওয়া হয়নি। শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় সে। এ নিয়ে প্রায়ই ভাবি জাহানারা তাকে নানাভাবে উপহাস করত।
মঙ্গলবার রাতেও তাকে নিয়ে উপহাসের এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তাহের ক্ষিপ্ত হয়ে ভাবি জাহানারার ওপর আক্রমণ করে। মূলত ভাবিকে হত্যার জন্যই সে আক্রমন করেছিল। এ সময় তার চিৎকারে অন্তঃসত্তা ভাতিজি শারমীন, ছেলে সুজাত ও প্রতিবেশী শিমুল মিয়া এগিয়ে আসার কারণে তাদের উপরও হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান জাহানারা।
পরে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে তাহেরকে আটক করেন। খবর পেয়ে জাহানারার মৃতদেহ উদ্ধার ও তাহেরকে আটক করে মাধবপুর থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। এদিকে বুধবার সকালে ময়নাতদন্তের জন্য নিহত ৩ জনের মরদেহ হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে পুলিশ। এর আগে রাতে পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
ওই সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক তাহের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করে। মূলত ভাবিকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। কারণ ভাবি তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন পাশাপাশি উপহাসও করতেন। কিন্তু ঘটনার সময় জাহানারার মেয়ে এক সন্তানের জননী অন্তস্বত্তা শারমিন (২৫) এগিয়ে এলে তাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়।
এ দৃশ্য দেখে জাহানারার ছোট পুত্র সুজাত (১০) এগিয়ে গেলে সুজাতকেও ছুরিকাঘাত করে তাহের। কান্নাকাটির শব্দ শুনে প্রতিবেশী আব্দুল আলীমের পুত্র শিমুল (২৫) ঘরে উকি দিতেই তাহের রক্ত মাখা ছুরি নিয়ে শিমুলকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয় এবং গলায় গামছা প্যাচিয়ে শিমুলকে আটকে ফেলে। পরে পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়।ঘটনাস্থলেই জাহানারা বেগম মারা যায়। শিমুল ও শারমিনকে মাধবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক দুইজনকে মৃত ঘোষনা করেন। গুরুতর আহত সুজাতকে ঢাকা সোহরাওয়াদী হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তবে তার অবস্থাও সংকটাপন্ন। তাকে আইসিসিউতে রাখা হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত জাহানারার দুলা ভাই হাজী মোঃ মোহন মিয়া বাদি হয়ে মাধবপুর থানায় মামলা দায়ের করেন মঙ্গলবার রাতে।
পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে সৌদি প্রবাসী বড় ভাই গিয়াস উদ্দিন ও তার স্ত্রী জাহানারা বেগমের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনায় দুই বছর আগে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ভাবি জাহানারা বেগম মাধবপুর থানায় একটি সাধারন ডায়রি করেন। তখন থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক আনিসুর রহমান সরজমিনে গিয়ে তদন্ত করেন। গ্রাম্য শালীসে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দেয়া হয়।
এরপর থেকে ভিতরে ভিতরে জাহানারার প্রতি তাহের ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ট্রিপল মার্ডারের ৮দিন আগে তাহের মিয়া বিদায় নিয়ে ইরাকের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু গত সোমবার আবার বাড়িতে এসে ভাবির নিকট জরুরী প্রয়োজনে এক লাখ টাকা চায়। টাকা না দেওয়াতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।